ফেরেশ্তার প্রতি ঈমান প্রত্যেকের জন্য এ বিশ্বাস করা অপরিহার্য যে, ফেরেশ্তাগণ আল্লাহ্ তাআলার সৃষ্টির অন্তর্গত। তাঁদের সংখ্যা কত, সেটা তিনি ব্যতীত আর কেউ জানে না। তাঁদের সম্পর্ক অদৃশ্য জগতের সঙ্গে। আল্লাহ্ তাআলা তাঁদেরকে নিজের ইবাদত ও আনুগত্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা বিশ্বজগত তথা এর সৃষ্টিকুলের প্রশাসনিক কাজ-কর্ম থেকে শুরু করে তাদের পর্যবেক্ষণ, পরিদর্শন, নিরাপত্তাসহ আল্লাহ্ তাআলার যাবতীয় নির্দেশ পালন করেন। এসবকিছু করেন আল্লাহ্ তাআলার ইচ্ছা ও নির্দেশানুক্রমে।
কুর্আনআল্লাহ্ তাআলা বলছেন : "”মাসীহ্ (ইসা) এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ফেরেশ্তাগণ আল্লাহ্র বান্দা হতে কখনো উন্নাসিকতা প্রদর্শন করে না”। [সূরা নিসা ৪:১৭২]
ফেরেশ্তাগণ আল্লাহ্ এবং তাঁর নবিদের মাঝে দূতরূপে কাজ করেন। আল্লাহ্ তাআলা বলছেন : “বিশ্বস্ত রূহ্ (জিব্রাইল (আঃ)) এটা নিয়ে অবতরণ করেছেন; তোমার হৃদয়ে যাতে তুমি সতর্ককারী হতে পারো; অবতীর্ণ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়”। [সূরা শুআ’রা ২৬: ১৯৩-১৯৫]
আল্লাহ্ তাআলা ফেরেশ্তাদের উপর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব অর্পণ করেছেন এবং তারা তাই করেন যা তাঁদেরকে আদেশ করা হয়। আল্লাহ্ সুব্হানাহু ওয়া তাআলা বলেন : “তারা তাদের উপর পরাক্রমশালী তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এবং তাদেরকে যা আদেশ করা হয় তারা তা করে”। [সূরা নাহ্ল ১৬:৫০]
ফেরশ্তাগণ আল্লাহ্র অংশীদার, সহযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়; তাঁরা তাঁর সন্তানও নয়। তথাপি প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য তাঁদেরকে শ্রদ্ধা করা এবং ভালোবাসা। আল্লাহ্ তাআলা বলছেন : “আর তারা বলে, দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন (ফেরেশ্তাদের মধ্য হতে)। তিনি সর্বপ্রকার অসম্পূর্ণতা হতে পবিত্র। তাঁরা তো সম্মানিত বান্দা। তাঁরা তাঁর আগে বেড়ে কথা বলে না। তাঁরা তো তাঁর নির্দেশানুক্রমেই কাজ করে”। [সূরা আন্বিয়া ২১:২৬-২৭]
তাঁরা তাঁদের সময় অতিবাহিত করেন আল্লাহ্ তাআলার ইবাদত, আনুগত্য, তাঁর সপ্রশংসা পবিত্রতা ঘোষণায়। আল্লাহ্ সুব্নাহু ওয়া তাআলা বলেন : “তারা দিবারাত্রি তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং তারা ক্লান্তিবোধ করে না”। [সূরা আন্বিয়া ২১:২০]
হাদিসফেরেশ্তা জ্যোতি হতে সৃষ্ট। রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন : “ফেরেশ্তা জ্যোতি হতে সৃষ্টি, জিন ধোঁয়াবিহীন আগুন হতে সৃষ্টি এবং আদম কী থেকে সৃষ্টি তার বিবরণ তোমাকে দেয়া হয়েছে (কালো শুষ্ক মৃত্তিকা)”। (সহি মুস্লিম : ২৯৯৬)
যদিও তারা জ্যোতির তৈরি, তথাপি তাদেরকে দেখতে পাওয়া যায় না। আল্লাহ্ তাআলা তাদেরকে নিজেদের আকার পরিবর্তন করার ক্ষমতা দান করেছেন যেন তাদেরকে দেখা যায়, প্রত্যক্ষ করা যায়। আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে জানান দিচ্ছেন যে, জিব্রাইল (আঃ) মারয়ম (আঃ)-এর নিকট মানুষের আকারে আগমন করেছিলেন। “তাদের হতে নিজেকে আড়াল করবার জন্য তিনি পর্দা করলেন। অতঃপর আমি তার নিকট আমার রূহকে (জিব্রাইলকে) পাঠালাম। তিনি তাঁর নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করলেন। তিনি (মারয়ম) বললেন : আমি মহাকরুণাময়ের নিকট তোমার হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহ্কে ভয় করো। তিনি (জিব্রাইল) বললেন : আমি তো কেবল তোমার প্রতিপালকের প্রেরিত দূত, তোমাকে এক পবিত্র সন্তান দান করার জন্য এসেছি”। [সূরা মারয়াম ১৯:১৭-১৯]
আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন : “রাত্রিবেলায় তোমাদের সঙ্গে একাংশ ফেরেশ্তা থাকেন এবং দিনের বেলায় অন্য একাংশ থাকেন। তাঁরা আসর এবং ফজরের সময় একত্রিত হন। অতঃপর যারা তোমাদের সঙ্গে রাত্রি যাপন করেন, তাঁরা উপরে উঠে যান। আল্লাহ্ তাআলা তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন –অথচ তিনি তোমাদের সম্পর্কে সবকিছুই জানেন- “কী অবস্থায় তোমরা আমার বান্দাদেরকে ছেড়ে এলে ?” ফেরেশ্তাগণ উত্তর দেবেন : যখন আমরা তাদেরকে ছেড়েছি, তখন তারা স্বালাত প্রতিষ্ঠা করছিল আর যখন তাদের নিকট গিয়ে পৌঁছে ছিলাম, তখনও তারা স্বালাত আদায় করছিল”। (সহি বুখারি : ৭৪২৯)
আনাস বিন মালিক (রাঃ) বর্ণনা করছেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ্ একজন ফেরেশ্তাকে মাতৃগর্ভে নিযুক্ত রেখেছেন। ফেরেশ্তাটি বলবেন : হে প্রভু !এ তো বীর্য; হে প্রতিপালক ! এ তো রক্তপিণ্ড; হে রব ! এ তো মাংসপিণ্ড; অতঃপর আল্লাহ্ যদি শিশুটির সৃষ্টি সম্পূর্ণ করতে চান তাহলে ফেরেশ্তা বলেন : হে প্রভু ! সে ছেলে হবে না মেয়ে হবে ? হে প্রভু ! সে পাপিষ্ঠ হবে না নেককার হবে ? তার জীবিকা কী হবে ? তার আয়ুষ্কাল কত হবে ? যখন শিশুটি তার মাতৃগর্ভেই থাকে, তখনই ফেরেশ্তা এসবকিছু লিপিবদ্ধ করে নেন”। (সহি বুখারি : ৩৩৩৩)
আবু তাল্হা (রাঃ) বর্ণনা করছেন : রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন : “যে ঘরে কুকুর বা ছবি থাকে, তাতে ফেরেশ্তা প্রবেশ করেন না”। (সহি বুখারি ৩৩২২)
দায়িত্বভারআল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে একাংশ ফেরেশ্তার নাম ও তাঁদের দায়িত্বভার সম্পর্কে জানিয়েছেন। যেমন জিব্রাইলকে (আঃ) প্রত্যাদেশের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আল্লাহ্ তাআলা বলছেন : “বিশ্বস্ত রূহ্ (জিব্রাইল (আঃ)) এটা নিয়ে অবতরণ করেছেন; তোমার হৃদয়ে যাতে তুমি সতর্ককারী হতে পারো; অবতীর্ণ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়”। [সূরা শুআ’রা ২৬: ১৯৩-১৯৫]
ইস্রাফিলকে (আঃ) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কিয়ামতদিবসে শিঙায় ফুৎকার দেয়ার এবং মিকাইলকে (আঃ) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বৃষ্টি বর্ষণ ও শষ্য উৎপাদনের।
প্রত্যেকটি মানুষের জন্য দুজন ফেরেশ্তা নিযুক্ত রয়েছেন, একজন তার সৎকর্মগুলি নথিভুক্ত করছেন এবং অন্যজন লিপিবদ্ধ করছেন তার অসৎকর্মগুলি। আল্লাহ্ তাআলা বলছেন : “স্মরণ রেখো, দুই গ্রহণকারী (ফেরেশ্তা) তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে”। [সূরা ক্বাফ ৫০:১৭]
মানুষের মৃত্যুক্ষণ এসে পৌঁছিলে তাদের প্রাণ হরণ করবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মৃত্যুর ফেরেশ্তাকে (মালাকুম মাওতকে)। আল্লাহ্ তাআলা বলেন : “বলো, তোমাদের জন্য নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেশ্তা তোমাদের প্রাণ হরণ করবেন। পরিশেষে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে”। [সূরা সাজদা ৩২:১১]
ফেরেশ্তাগণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য। “মানুষের জন্য তার সামনে ও পেছনে একের পর এক প্রহরী থাকে; তারা আল্লাহ্র আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে”। [সূরা রা’দ ১৩:১১]
মালিক জাহান্নামের প্রহরী। আল্লাহ্ তাআলা বলছেন : “তারা চিৎকার করে বলবে : হে মালিক (জাহান্নামের প্রহরী), তোমার প্রতিপালক আমাদেরকে নিঃশেষ করে দিন। তিনি বলবেন : তোমরা তো সর্বদা এখানেই অবস্থান করবে”। [সূরা যুখ্রুফ ৪৩:৭৭]
রিয্ওয়ান জান্নাতের অধিকর্তা। আরও অনেক ফেরেশ্তা আছেন। প্রত্যেকের এক একটি করে দায়িত্বভার রয়েছে। একাংশের কথা কুর্আন ও সুন্নাতে উল্লেখ রয়েছে। অনেকের কথা উল্লেখ নেই; কিন্তু তাদের প্রতি ঈমান আনা আমাদের জন্য অপরিহার্য। [১]
কতিপয় ফেরেশ্তার নাম ও তাঁদের দায়িত্বভারপ্রত্যেক মুসলমানের জন্য সকল ফেরেশ্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য, তাদের নাম কুর্আন ও হাদিসে উল্লেখ থাক আর নাই থাক। কতিপয় ফেরেশ্তার নাম ও দায়িত্ব উল্লেখ করা হলো :
ফেরেশ্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের সুফল১। বান্দা আল্লাহ্র মহত্ত্ব, তাঁর শক্তি, ক্ষমতা এবং সর্বত্র পরিব্যাপ্ত তাঁর জ্ঞানের কথা বুঝতে পারে। তাঁর সৃষ্টির মহত্ত্বই প্রমাণ করে দেয় যে, স্রষ্টা কত মহান।
২। যখন একজন মুসলমান জানতে পারবে যে, কতিপয় ফেরেশ্তা তার সমস্ত কথা ও কর্ম লিপিবদ্ধ করছেন এবং প্রত্যেকটি জিনিস হয় তার পক্ষে দাঁড়াবে অথবা তার বিপক্ষে দাঁড়াবে, তখন সে সৎকর্ম করার প্রতি উৎসাহী ও উদগ্রীব হবে এবং নির্জনে ও জনপদে তথা সর্বত্র অন্যায় ও পাপকার্য হতে বিরত থাকবে।
৩। সে কুসংস্কার ও মিথ্যা উপকথা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে।
৪। আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় বান্দাদের প্রতি কত অনুগ্রহশীল, তারা তা অনুভব করতে পারে; কারণ আল্লাহ্ তাআলা প্রত্যেক ব্যক্তির রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার কার্যক্রমের প্রতি প্রহরীস্বরূপ এক একজন করে ফেরেশ্তা নিযুক্ত রেখেছেন। [৩]
আরও দেখুনআল্লাহ্, ইসলামের দৃষ্টিতে ফেরেশ্তা, ঈমানের স্তম্ভসমূহ;
তথ্যসূত্র[১] [৩] http://www.1ststepsinislam.com/en/belief-in-angels.aspx [২] http://muttaqun.com/angels.html
|
.