গীবত বা পরনিন্দা


গিবত বলতে বোঝায় কারো অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কিছু বলা যার প্রচার বা আলোচনা সে পছন্দ করে না। বুহ্‌তান বা অপবাদ বলতে বোঝায় কোনো মুসলমান সম্পর্কে এমন কিছু বলা যা সত্য নয়্‌, বা কারো প্রতি মিথ্যারোপ করা। নামিমা বা চুগলখোরি বলতে বোঝায় কাউকে এমন কিছু বলা যাতে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় বা তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব জন্ম নেয়। [১]

 

বিষয়সূচি

 

কুরআন

“হে মুমিনগণ! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ইকতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃতোমরা তো একে ঘৃণাই করো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ইআল্লাহ্‌তওবা কবুলকারী,পরম দয়ালু”।[সূরা হুজ্‌রাত ৪৯:১২]  [২]

 

“যেদিন প্রকাশ করে দেবে তাদের জিহ্বা,তাদের হাত ও তাদের পা,যা কিছু তারা করত”। [সূরা নূর ২৪:২৪] [৩]

 

হাদিস

রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : “হে ওই মানবসমাজ যারা মৌখিক বিশ্বাস স্থাপন করেছ কিন্তু অন্তরে ঈমান বদ্ধমূল হয়নি ! তোমরা মুসলমানদের নিন্দা করো না এবং তাদের ভুলত্রুটি অনুসন্ধান করো না, কারণ কেউ তাদের ভুলত্রুটি সন্ধান করে তাহলে আল্লাহ্‌ তার ভুলত্রুটি সন্ধান করবেন। আর যদি আল্লাহ্‌ কারো ভুলত্রুটি সন্ধান করেন তাহলে তিনি তাকে প্রকাশ্যে সবার চোখের সামনে লাঞ্ছিত করবেন, যদিও সে তা গৃহাভ্যন্তরে লুক্কায়িত রাখে”। (আবুদাউদ : ৪৮৬২, তিরমিযি : ১৬৫৫, আলবানি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন)।

 

সাহ্‌ল ইবনে সা’দ (রা.) বর্ণনা করছেন, রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী অঙ্গ এবং দুই উরুর মধ্যবর্তী অংশের (জিহ্বা ও গুপ্তাঙ্গ) (হেফাজতের) মুচলিকা দেবে আমি তাকে জান্নাতের মুচলিকা দেব”। (সহি বুখারি : ৬৪২২)

 

“যে কেউ আল্লাহ্‌ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা নীরব থাকে”। (সহি বুখারি : ৩১৫৪ ও তিরমিযি : ১৯৬৭) [৪]

 

পরনিন্দার শাস্তি জাহান্নাম

মহানবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেন : “আমাকে আকাশে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম যাদের নখগুলি ছিল তামার এবং তাদ্বারা তারা নিজেদের মুখমণ্ডল ও ছাতি চেঁচে ফেলছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম : জিব্রাইল ! এরা কারা ? তিনি উত্তর দিলেন : এরা ওই সমস্ত লোক যারা পরনিন্দা করত এবং মানুষের সম্মান ক্ষুণ্ন করত”। (সুনানে আবু দাউদ : ৪৮৬০) [৫]

 

বিদ্বানগণ বলেছেন যে, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে গীবত বা পরনিন্দা বৈধ। যথা :

১। নালিশ জানানোর জন্য। কেউ অত্যাচারিত হলে তার অত্যাচারের প্রতিকার পাওয়ার জন্য শাসক বা বিচারক ও অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট অত্যাচারী ব্যক্তির নিন্দা করা বৈধ।

২। অপকর্ম দূরীকরণ ও পাপীকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য নিন্দা করা বৈধ। যে কিছু করতে পারে এমন আশা করা যায় তার নিকট বলতে পারা যায় : “অমুক ব্যক্তি এমন এমন কাজ করছে; তাকে বলুন সে যেন এমন না করে”।

৩। উপদেশ বা ফতওয়া কামনা করা, মুফতিকে বলতে পারা যায় : “অমুক ব্যক্তি / আমার পিতা / আমার ভাই আমার উপর এমনভাবে অন্যায় করেছে, সে কি এমন করার অধিকার রাখে ? কীভাবে আমি এই সমস্যার সমাধান করতে পারি এবং তার অনিষ্ট হতে আমি নিষ্কৃতি পেতে পারি ?”

৪। কারো অনিষ্ট সম্পর্কে মুসলমানদেরকে সতর্ক করার জন্য, যেমন কিছু বর্ণনাকারী বা সাক্ষী বা লেখকের দুর্বলতা জনমানসে প্রকাশ করা। এরই মধ্যে রয়েছে : আপনি কাউকে দেখছেন ত্রুটিপূর্ণ সামগ্রী বিক্রয় করছে, বা কেউ কোনো চোর বা ব্যভিচারীর সঙ্গ অবলম্বন করছে, অথবা তার সঙ্গে স্বীয় আত্মীয়র বিবাহ দিচ্ছে, ইত্যাদি। ওই সময় আপনার উচিত আন্তরিক উপদেশস্বরূপ তাদেরকে ওই সম্পর্কে বলা। তবে তা যেন তার ক্ষতিসাধন ও তার সম্ভ্রম হননের উদ্দেশ্যে না হয়।

৫। যদি কোনো ব্যক্তি প্রকাশ্যে মন্দ কাজ করে বা বিদ্‌আতের অনুসরণ করে, যেমন মদ্যপান, অবৈধ পথে মানুষের সম্পদ হরণ। সে যা প্রকাশ্যে করছে তা অন্যদের সামনে উল্লেখ করা বৈধ। তবে অন্য কোনোভাবে তার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না যতক্ষণ না অন্য কোনো কারণ পাওয়া যায়।

৬। পরিচিতির জন্য, যদি কেউ ডাক নামে পরিচিত হয়, যেমন আধকানা বা অন্ধ বা পঙ্গু। তার পরিচিতির জন্য এমন বলা বৈধ। তবে তার মর্যাদাহানীর জন্য তা উল্লেখ করা হারাম। আর যদি অন্যভাবে তার পরিচিতি দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে তাই ভালো। [৬]

 

উলামাদের মতামত

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন :

যে কেউ কারো প্রতি অপবাদ দেয়, নিন্দা করে বা অমর্যাদা করে, অতঃপর তওবা করে তাহলে আল্লাহ্‌ তাআলা তার তওবা গ্রহণ করবেন। কিন্তু অত্যাচারিত ব্যক্তি যদি তা জানতে পারে তাহলে তার প্রতিকারের অধিকার তার আছে। কিন্তু যদি সে তার প্রতি অপবাদ দেয় বা তার পশ্চাতে নিন্দা করে এবং সে তা শুনে না থাকে তাহলে এক্ষেত্রে উলামাদের দুটি মত রয়েছে। দুটি মতই ইমাম আহ্‌মাদ বর্ণনা করেছেন। সঠিক মতটি হলো : তাকে বলাই উচিত নয় যে, সে তার অনুপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে কিছু বলেছে। অপর মতটি হলো : তার অনুপস্থিতিতে তার সম্বন্ধে ভালো কিছু বলা উচিত, যেমন তার সম্পর্কে মন্দ বলেছিল। হাসান বাসারি বলেন : গীবতের প্রতিকার হলো সে যার নিন্দা করেছে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা। (আল-মাজ্‌মু ৩/২৯১)[৭]

 

আরও দেখুন

পাপ; মিথ্যা; উপহাস; শিক্ষার্জন; মহাপাপ;

 

তথ্যসূত্র

[১] [৭] http://islamqa.info/en/ref/23328

[২] http://quran.com/49/12

[৩] http://quran.com/24/24

[৪] http://www.sunnah.com

[৫] http://www.sunnah.com/abudawud/43#106

[৬] http://islamqa.info/en/ref/105391/Backbiting

1304 Views
Correct us or Correct yourself
.
Comments
Top of page