হিজাবহিজাব একটি আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ অবগুণ্ঠন, পর্দা, আচ্ছাদন বা আবরণ। [১]
সূচনাকুরআনের দৃষ্টিতে শালীনতার সম্পর্ক রয়েছে পুরুষ ও নারীর দৃষ্টি, বিচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ ও জননেন্দ্রিয়ের সাথে। হিজাব প্রথমে পুরুষদের জন্য, তারপর নারীদের জন্য। মুসলমানদের বিশ্বাস, তাদের জীবনের মূল লক্ষ কুরআন ও মহানবি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পথনির্দেশিকা অনুসারে শুধুমাত্র আল্লাহ্ তাআলার ইবাদত ও আরাধনা করা। হিজাব আল্লাহ্ তাআলার আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ তাআলা বলেন : “আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনোকাজের আদেশ করলে কোনোঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন এখতিয়ারনেই;আর যে ব্যক্তিআল্লাহ্ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়”। [সূরা আহ্যাব ৩৩:৩৬]
পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে, নারীদের জন্য হিজাবের বিধান দেওয়া হয়েছে, যাতে করে তারা শালীন ও পুতপবিত্র বলে পরিচিতি পায় এবং কেউ তাদেরকে উত্যক্ত করতে না পারে। শালীনতা ও লজ্জাশীলতা ঈমানের নিদর্শন। যার মধ্যে শালীনতা ও লজ্জাশীলতা (হিজাব) নেই তার কোনো ধর্ম নেই। হিজাব নারীদের মানহানী করে না, বরং তাদের মান বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় এবং তাদের শালীনতা ও পবিত্রতা সুরক্ষিত রাখে। হিজাব পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা জাগ্রত করে এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
ইসলামি অর্থহিজাব বলতে অবগুণ্ঠন ও আবরণ উভয়কেই বোঝায়। আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলছেন : “কোনোমানুষের জন্য এমন হওয়ার নয় যে,আল্লাহ্তার সাথে কথা বলবেন। কিন্তু অহির মাধ্যমে অথবা পর্দার অন্তরাল থেকে অথবা তিনি কোনোদূত প্রেরণ করবেন”। [সূরা শূরা ৪২:৫১]
“যখন আপনি কুরআন পাঠ করেনতখন আমি আপনার মধ্যে ও পরকালে অবিশ্বাসীদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন পর্দা ফেলে দিই”। [সূরা ইসরা ১৭:৪৫] [৩] [৪]
কুরআন“ঈমানদার নারীদেরকে বলো :তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনমিতরাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গেরহেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান,তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না ঘাড় ও বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তাদের স্বামী,পিতা, শ্বশুর,পুত্র,স্বামীর পুত্র,ভ্রাতা,ভ্রাতুস্পুত্র,ভগ্নিপুত্র,স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী,যৌনকামনামুক্ত পুরুষও বালক,যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ,তাদের ব্যতীত কারো কাছেতাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে,তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ !তোমরা সবাই আল্লাহ্র সামনে তওবা করো,যাতে তোমরা সফলকাম হও”। [সূরা নূর ২৪:৩১]
“হে নবি ! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন,তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ্ক্ষমাশীল পরম দয়ালু”। [সূরা আহ্যাব ৩৩:৫৯]
“তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবেএবং অজ্ঞতারযুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। নামায প্রতিষ্ঠাকরবে,যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ্ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে। হে নবি-পরিবারের সদস্যবর্গ!আল্লাহ্কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পুতপবিত্র রাখতে”।[সূরা আহ্যাব ৩৩:৩৩]
“তোমরা তাঁর পত্নীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের অন্তরের জন্যে এবং তাঁদের অন্তরের জন্যে অধিকতর পবিত্রতার কারণ”। [সূরা আহ্যাব ৩৩:৫৩]
হাদিসসাফিয়া বিনতে শায়বা (রা.) হতে বর্ণিত, আয়েশা (রা.) বলেন : “তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে (অর্থাৎ তাদের শরীর, মুখমণ্ডল, কাঁধ ইত্যাদি) ফেলে রাখে” যখন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হলো তখন তাঁরা তাঁদের ইযার (এক ধরনের পোষাক) নিয়ে তার কিয়দংশ কেটে নিয়ে তা দিয়ে চেহারা আবৃত করলেন”। (সহি বুখারি : ৪৪৮১) [৮]
আব্দুল্লাহ্বর্ণনা করছেন যে, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “নারী হলো আওরাহ্, যখন সে বেরোয় তখন শয়তান তার পিছু নেয়”। (তিরমিযি : ১১৭৩, আলবানি হাদিসটিকে সহি বলেছেন)
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করছেন : “আমরা রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের)-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম । পথচারীগণ আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করত। তারা আমাদের নিকট আসলে আমরা মাথার উপর থেকে নেকাব চেহারায় ফেলে দিতাম। তারা চলে গেলে নেকাব উঠিয়ে নিতাম”। ( সুনানে আবু দাঊদ :১৮৩৩; আহ্মাদ : ২৪০৬৭; ফাতহুল বারি৩/৪৭৪; আল্বানি ‘জিলবাব আল-মারআহ্ আল-মুসলিমাহ্’ (১০৭)-এর মধ্যে হাদিসটিকে সহি বলেছেন)।
পুরুষদের জন্য হিজাবপবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে, আল্লাহ্ তাআলা বলছেন : “মু’মিনদেরকে বলো,তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গেরহেফাজত করে। এতে তাদের জন্য অতীবপবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ইতারা যা করে আল্লাহ্সে সম্পর্কেঅবহিত আছেন”। [সূরা নূর ২৪:৩০]
নারীদের জন্য হিজাবপবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে, আল্লাহ্ তাআলা বলছেন : “ঈমানদার নারীদেরকে বলো :তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনমিতরাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গেরহেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান,তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তাদের স্বামী,পিতা, শ্বশুর,পুত্র,স্বামীর পুত্র,ভ্রাতা,ভ্রাতুস্পুত্র,ভগ্নিপুত্র,স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী,যৌনকামনামুক্ত পুরুষও বালক,যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ,তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে,তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ !তোমরা সবাই আল্লাহ্র সামনে তওবা করো,যাতে তোমরা সফলকাম হও”। [সূরা নূর ২৪:৩১]
গায়ের মাহ্রামের সাথে করমর্দনগায়ের মাহ্রামের সঙ্গে করমর্দন করা বৈধ নয়, কারণ মহানবি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন : “তোমাদের যে করো মাথায় লোহার সুচ বিদ্ধ করা হোক, এটা তার জন্য অধিক শ্রেয় এমন মহিলার হাত স্পর্শ করা অপেক্ষা যে তার জন্য বৈধ নয়”। (তাবারানি মু’জামুল কাবির : ২০/২১৩; মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা : ৪/৩৪১)
হিজাবের বয়সপুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য সাধারণভাবে বয়োসন্ধি বা যৌবনের তিনটি নিদর্শন : ১। স্বপ্নদোষ ২। গুপ্তাঙ্গে চুল গজানো ৩। চোদ্দ বছর বয়সে উপনীত হওয়া (আরবে এর থেকে কম) নারীদের ক্ষেত্রে একটি চতুর্থ নিদর্শন আছে, তা হলো : ৪। ঋতুস্রাব কোনো মেয়ের মধ্যে বয়োসন্ধির লক্ষণগুলির কোনো একটিও প্রকাশ পেলে তার জন্য সমস্ত ফরজ দায়িত্বগুলি পালন করা এবং যাবতীয় হারাম জিনিস বর্জন করা অপরিহার্য। অত্যাবশ্যক কর্তব্যগুলির মধ্যে একটি অন্যতম হলো হিজাব পরিধান করা। [১০]
হিজাবের শর্তাবলি
এই কড়াকড়ির কারণ, যেন নারীরা পুরুষদের লোভাতুর ও কামদৃষ্টি হতে সুরক্ষিত থাকে। তার কর্তব্য কোনোভাবে নিজের প্রতি কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না করা। কোনো মহিলার প্রতি পুরুষের আকস্মিক নজর পড়ে গেলে তা মার্জনীয়, কিন্তু দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত করা তার জন্য বৈধ নয়, কারণ এই দৃষ্টিই কামুক চিন্তাভাবনা জাগ্রত করে।
ইসলাম নারীদেরকে নিরাপত্তা দেয়, এজন্যই আল্লাহ্ তাআলা এই বিধানগুলি দিয়েছেন। বর্তমান সমাজে নারীজাতিকে নিজের লাভের জন্য অবৈধভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে নারীর যৌনতা প্রকাশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, বিশেষ করে পুরুষদের প্রবৃত্তিকে আকৃষ্ট করার জন্য এবং বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য বিক্রি করার জন্য। বর্তমান সমাজে কি নারী সত্যিই স্বাধীন ? জবাব স্পষ্ট, না। ইসলাম ১৪০০ বছর পূর্বেই নারীদের প্রকৃত স্বাধীনতা দিয়েছে। [১১]
হিজাব দাওয়াতস্বরূপহিজাব হতে শালীনতা, পবিত্রতা ও শ্রদ্ধা প্রতিফলিত হয়। এটা দুর্বৃত্তি কমায়, যার ফলে আরও অনেক ভয়ংকর পাপ হতে নিবৃত্ত থাকার পথ সুগম হয়ে যায়। এটা মহিলাদেরকে পুরুষদের অনিষ্ট ও উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করে। একজন মস্তকাবৃত নারী বার্তা দেয় যে, সে মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন সদস্য এবং নৈতিক কার্যকলাপের একটি বিশেষ বিধানকে অনুসরণ করে।
হিজাব পরিধান করতে শুরু করেই একজন মহিলা সামান্য চেষ্টায় তার কর্তব্যের একটা বড়ো অংশ পালন করে নেয়। যখনই সে মুদীখানায়, গ্রন্থালয়ে, কর্মক্ষেত্রে, বিদ্যালয়ে বা অন্য কোনো জনসভায় যায় তখন সে ইসলামের অত্যুৎকৃষ্ট বার্তা বিস্তার করে। এর কারণ শুধু তার পরে থাকা বাহ্যিক হিজাব নয়, বরং তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তার শালীন ব্যবহার। যখন কোনো রমণী পুরুষদের সাথে ছিনাল থেকে বিরত থাকে, শারীরিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সংরক্ষণশীলা থাকে তখন মানুষ কৌতুহলী হতে পারে এবং এই আকিদা সম্পর্কে আরও বেশি জানার আগ্রহ তাদের মনে তৈরি হয়। (ডা. আইশা হামদান, আল-জুমআ ম্যাগাজিন, সংখ্যা ১০, জুমাদাল উলা ১৪১৯ হি.) [১২]
পণ্ডিতগণের মতামতইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন : আল্লাহ্ তাআলা নারীদেরকে তাদের মুখমণ্ডলের উপর জিলবাব (চাদর) ঝুলিয়া দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা শ্রদ্ধেয়া ও শালীনতাসম্পন্না বলে পরিচিত হয় এবং তাদেরকে উত্যক্ত ও বিরক্ত না করা হয়। এই দলিলটি হতে প্রথম অভিমতটি সাব্যস্ত হচ্ছে। উবাইদা আল-সালমানি এবং আরও কতিপয় বিদ্বান বলেন : নারীরা তাদের জিলবাব মাথার উপর দিয়ে এমনভাবে ঝুলিয়ে দিত যে, তাদের চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যেত না। চলার পথ দেখার জন্য তারা চোখ খোলা রাখত। বিশুদ্ধ হাদিস হতে প্রমাণিত আছে যে, ইহ্রামের অবস্থায় মাহিলাদের জন্য নিকাব ও দস্তানা পরা নিষিদ্ধ। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, যারা ইহ্রামের অবস্থায় থাকত না তারা নিকাব ও দস্তানা পরত। এখান থেকে বোঝা যায় তারা তাদের চেহারা ও হাত আবৃত রাখত। (মাজ্মূ আল-ফাতাওয়া ১৫/৩৭১-৩৭২)
শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ্ উসাইমিন (রহ.) বলেন : শরিয়তে যে হিজাবের বিবরণ এসেছে তার অর্থ একজন মহিলা তার দেহের ওই সমস্ত অঙ্গ আবৃত রাখবে যেগুলো প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক। তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান হলো চেহারা, কারণ এটাই আত্মপ্রবৃত্তি ও কামভাবনার প্রবেশদ্বার।
মাহ্রাম নয় এমন প্রত্যেক পুরুষের সম্মুখে মহিলাদের জন্য তাদের চেহারা ঢাকার নির্দেশ এসেছে। এখান থেকে বুঝতে পারি যে, চেহারা আবৃত রাখা অত্যন্ত জরুরি। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, মহানবি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহ্ এবং সাহাবা কিরাম, ইমামগণ ও মুসলিম পণ্ডিতগণের অভিমত থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহিলাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখার ওই সমস্ত লোকের সামনে যারা মাহ্রাম নয়, অর্থাৎ যাদের সঙ্গে জীবনে কোনো সময় বিবাহ বৈধ। (ফাতাওয়া আল-মার্আহ্ আল-মুসলিমাহ্, ১/৩৯১, ৩৯২) [১৩]
তথ্যসূত্রHijab by Abdulaziz Addwesh, http://d1.islamhouse.com/data/en/ih_books/single/en_Hijab.pdf http://www.sultan.org/books/hijab.pdf [১] (Al Mawrid- a arabic english dictionary, 1992 p 453) [৯] [13] http://islamqa.info/en/ref/21536 [১০] http://islamqa.info/en/ref/20475 [১১] http://sisters.islamway.net/modules.php?name=News&file=article&sid=3 [১২] http://www.themodernreligion.com/women/w_hijabdawah.htm |
.