কুরআনের প্রতি শিক্ষানবিশদের জন্য পথনির্দেশ


কুরআন কী ?

কুরআন হলো আল্লাহ্‌ তাআলার আক্ষরিক ও বাচনিক বাণী যা জিব্রাইল (আ.)-এর মাধ্যমে নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রত্যাদিষ্ট হয়েছিল। তা মৌখিক ও লিখিত আকারে বিভিন্ন সূত্রে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। এটি অনুকরণীয় ও অনন্য এবং বিকৃতি হতে আল্লাহ্‌ কর্তৃক সুরক্ষিত। আল্লাহ্‌ তাআলা বলছেন : “আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক”। [সুরা হিজর: ৯]

 

বিষয়সূচি

 

বুনিয়াদ

কুরআন সম্পর্কে বুঝতে একজন শিক্ষানবিশের জন্য সর্বপ্রথম জিনিস তার রূপ। কুরআন একটি আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ ‘আবৃত্তি করা’ ও ‘পাঠ করা’। অনুরূপ কুরআন মৌখিকভাবে পাঠ করা হয়েছে এবং বইয়ের আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কুরআনের প্রকৃত ক্ষমতা মৌখিক আবৃত্তির মধ্যে রয়েছে, অর্থাৎ উচ্চ ও সুকণ্ঠে তিলাওয়াত করা হয়, কিন্তু এর আয়াতগুলো আত্মস্থ ও সংরক্ষণের মাধ্যমস্বরূপ সমসাময়িক উপলব্ধ উপকরণে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। এগুলো বইয়ের আকারে সংকলিত ও সুবিন্যস্ত করা হয়েছিল প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে, এবং পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিকভাবে। কুরআন মানে কালানুক্রমিক গল্প শোনানো নয়, আর এভাবে কুরআনকে অনুক্রমিক আখ্যান হিসেবে দেখা উচিত নয়।

 

কুরআন প্রায় একই আয়াত ও বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করে, ওগুলোর মধ্যে বিষয় পরিবর্তন করে এবং সংক্ষিপ্ত আকারে বিষয়গুলি বিবৃত করে। এর দুটি কারণ আমরা দেখতে পারি।প্রথম : এর মধ্যে আছে একটি ভাষাগত মাধুর্য্য এবং এটি ক্লাসিক আরবির একটি শক্তিশালী আলঙ্কারিক শৈলী। দ্বিতীয় : কুরআনের বিষয়াদি যতই বৈচিত্রময় হোক না কেন, সবগুলোই একটি কেন্দ্রীয় বার্তার চারিদিকে ঘোরাফেরা করে, আর তা হলো : “আল্লাহ্‌ ব্যতীত কোনো সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর প্রেরিত রসূল”। বংশতালিকা, কালানুক্রমিক ঘটনাবলি বা সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক বিবরণের সাথে কুরআনের সম্পর্ক নেই। ওগুলোর বেশিরভাগটাই মৌখিক বক্তৃতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন ঘটনা বিবৃত করে এই মূল বাণীটি অভিব্যক্ত করাই কুরআনের লক্ষ। তাই কুরআন যখনই মধুর পুষ্টিকর বৈশিষ্ট্য বা ইসা (আ.)-র জীবন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে তখন কোনো ঘটনাই শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করে না, কিন্তু প্রত্যেকটি ঘটনাই কোনো না কোনোভাবে কেন্দ্রীয় বার্তাটির সাথে সম্পর্কিত থাকে – আল্লাহ্‌র একত্ববাদ এবং নবিদের বার্তার অভিন্নতা।   

 

আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা মাথায় রাখতে হবে যে, সম্পূর্ণ কুরআন নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর একবারে অবতীর্ণ হয়নি, বরং তা ২৩ বছরে অল্প অল্প করে অবতীর্ণ হয়েছে। অধিকাংশ আয়াত বিশিষ্ট ঘটনার জবাবে ছিল। কুরআনি প্রত্যাদেশ আল্লাহ্‌ তাআলার পক্ষ হতে নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রায় অবতীর্ণ হতো ওই সমস্ত প্রশ্নের জবাবে যেগুলো অবিশ্বাসীরা তুলত। কুরআন সম্বোধন করে এই অবিশ্বাসীদেরকে, আহ্‌লে কিতাবকে (কুরআনে এই পরিভাষাটি ইহুদি ও খ্রিষ্টানের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে), বৃহৎ আকারে মানবতাকে, বিশ্বাসীদেরকে এবং সর্বোপরি স্বয়ং রসূলুল্লাহ্‌কে - তাতে তাঁকে নির্দেশ দিতেন কোনো নির্দিষ্ট অবস্থায় তাঁকে কী করতে হবে তার অথবা উপহাস ও প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখী হওয়ার সময় তাঁকে স্বান্তনাবার্তা দিতেন। অহির ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট কুরআনের মূল ভাবার্থকে সুস্পষ্ট করে।

 

কীভাবে কুরআন সুবিন্যস্ত হয় ?

কুরআনে ১১৪টি অংশ আছে। সবগুলি সমান লম্বা নয়। প্রত্যেকটি অংশকে আরবি ভাষায় সূরা বলে এবং প্রত্যেকটি বাক্য বা শব্দগুচ্ছকে আয়াত বলে যার আক্ষরিক অর্থ চিহ্ন। এই আয়াতগুলি দৈর্ঘে সমান নয়। প্রত্যেকটি আয়াতের আরম্ভ ও সমাপ্তির স্থান কোনো ব্যক্তি কর্তৃক নির্ধারিত নয়, বরং তা আল্লাহ্‌ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত।  

 

প্রত্যেকটি বাচনভঙ্গীর একটি পৃথক অংশ যা একটি চিহ্ন দ্বারা বিযুক্ত করা হয়, আরবি ভাষায় তার নাম দেওয়া হয় আয়াত। একটি ছাড়া সমস্ত সূরা বিস্‌মিল্লাহির রহ্‌মানির রহিম (আমি শুরু করছি পরম করুণাময় অসীম দয়াবান আল্লাহ্‌র নামে) দিয়ে শুরু হয়। প্রত্যেকটি সূরার একটি নাম আছে যা সাধারণত ওই সূরার কেন্দ্রীয় বক্তব্যের সাথে যুক্ত থাকে। যেমন, দীর্ঘতম সূরা “সূরা আল-বাকারা” বা “গরু”, এই নামকরণ করা হয় মুসা (আ.)-এর ঘটনার প্রেক্ষিতে যাতে তিনি ইহুদিদেরকে একটি গরু কুরবানি করতে আদেশ করছেন। ঘটনাটি শুরু হয় আল্লাহ্‌ তাআলার এই বাণী দিয়ে : “আর স্মরণ মুসাকে যখন তিনি স্বীয় সম্প্রদায়কে নির্দেশ বলেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গরু জবাই করার নির্দেশ করছেন”। [সূরা বাকারা ২:৬৭]

 

যেহেতু বিভিন্ন সূরার দৈর্ঘ বিভিন্ন, তাই রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরলোকগমনের পর প্রথম শতাব্দীর মুসলিম পণ্ডিতগণ কুরআনকে সমানভাবে ত্রিশটি অংশে বিভক্ত করেন, আরবি ভাষায় প্রতিটি অংশকে বলে “জুয্‌”। এটা করা হয়েছিল মানুষের সুবিধার্থে, যেন তারা খুব গুছিয়ে কুরআন পাঠ বা আত্মস্থ করতে পারে। কুরআনের প্রকৃত বিন্যাসের উপর এর কোনো প্রভাব পড়ে না। অংশটিকে চিহ্নিত করার জন্য পৃষ্ঠার একপাশে শুধুমাত্র কিছু প্রতীক দেওয়া থাকে। রমযান মাসে প্রত্যেক রাত্রে সাধারণত এক ‘জুয্‌’ করে পাঠ করা হয় এবং রমযান শেষে কুরআন পাঠ সম্পূর্ণ করা হয়।

 

কুরআনের শৈলী  

কী ধরনের বিষয়গুলি কুরআনে আলোচিত হয়েছে ? কুরআন বিভিন্নমুখী আলোচনায় সমৃদ্ধ। সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে কুরআন আলোচনা করে আল্লাহ্‌ তাআলার একত্ববাদ এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনার্থে একটি সুন্দর জীবন যাপন করার পদ্ধতি সম্পর্কে। অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে আছে : ধর্মীয় মতবাদ, সৃষ্টি, ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইন, ইহুদিধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও শির্‌ক, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ইতিহাস, পূর্ববর্তী নবিদের ঘটনাবলি এবং বিজ্ঞান। এই সমস্ত বিষয় আলোচনায় কুরআনের বর্ণনাশৈলীর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি হলো :

১। পাঠককে কৌতুহলী করার জন্য উপদেশপূর্ণ ছোটো ছোট গল্পের অবতারণা এবং গভীর সত্যের বিশ্লেষণ।

 

২। ২০০ও বেশি আয়াত ‘ক্বুল’ (বলো) শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছে। এইভাবে আল্লাহ্‌ তাআলা নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ প্রদান করেছেন কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে, বিশ্বাস সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের বিশ্লেষণ করতে, কিংবা কোনো নিরঙ্কুশ বিধান ঘোষণা করতে। যেমন :

“বলো :হে আহলে-কিতাবগণ !একটি বিষয়ের দিকে এসো যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান। তা হলো :আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না,তাঁর সাথে কোনোঅংশীসাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে পালনকর্তা বানাব না। তারপর যদি তারা স্বীকার না করেতাহলে বলে দাও :সাক্ষী থাকো যে,আমরা তো অনুগত”। [সুরা ইমরান: ৬৪]

 

৩। বহু আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর খুব গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টির শপথ করেছেন। সেটা তিনি করেছেন কোনো বক্তব্যকে জোরদার করার জন্য এবং শ্রোতার মস্তিষ্ক হতে সংশয় দূরীকরণের জন্য। যেমন :

“শপথ সূর্যের ও তার কিরণের।  

শপথ চন্দ্রের যখন তা সূর্যের পশ্চাতে আসে। 

শপথ দিবসের যখন সে সূর্যকে প্রখরভাবে প্রকাশকরে।

শপথ রাত্রির যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে।

শপথ আকাশের এবং যিনি তা নির্মাণ করেছেনতাঁর।

শপথ পৃথিবীর এবং যিনি তা বিস্তৃত করেছেন, তাঁর।

শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তাঁর। [সূরা শাম্‌স ৯১:১-৭]

অনেক সময় আল্লাহ্‌ তাআলা নিজের শপথ করেছেন :

“অতএব,তোমার পালনকর্তার কসম,ওই সমস্তব্যক্তিঈমানদার হবে না,যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনোরকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হূষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে”।[সূরা নিসা: ৬৫]

 

৪। অবশেষে, কুরআনে এসেছে কিছু অসংলগ্ন অক্ষর, যেগুলো “হুরুফে মুক্বাত্ত্ব’আত” নামে পরিচিত। ওগুলোর অর্থ শুধুমাত্র আল্লাহ্‌ তাআলা জানেন। আল্লাহ্‌ তাআলা এগুলোর মাধ্যমেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন ওই আরববাসীকে যারা ছিল সর্বাপেক্ষা বাগ্মী ও কাব্যপ্রতিভাসম্পন্ন। কিন্তু তাদের কেউ এধরনের অলঙ্কারপূর্ণ বর্ণসমষ্টি রচনা করতে সক্ষম হয়নি। ২৯টি সূরার প্রারম্ভে হুরুফে মুক্বাত্ত্ব’আত এসেছে। যেমন, সূরা বাকারার প্রথম আয়াত।

 

কুরআনের অনুবাদ

একজন শিক্ষানবিশের জন্য অনুবাদের ব্যাপারে কয়েকটি পয়েন্ট জানা দরকার। প্রথম : কুরআন এবং এর অনুবাদের মধ্যে পার্থক্য আছে। খ্রিষ্টানদের নিকট বাইবেল যে ভাষাতেই হোক, সেটা বাইবেল। কিন্তু কুরআনের অনুবাদ আল্লাহ্‌ তাআলার বাণী নয়, কারণ কুরআন আল্লাহ্‌ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট খাঁটি আরবি ভাষা যা জিব্রাইল (আ.)-এর মাধ্যমে নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। আল্লাহ্‌ তাআলার বাণী কেবল আরবি কুরআন। যেমন আল্লাহ্‌ তাআলা বলছেন : “নিশ্চয়ই আমি একে আরবি কুরআনরূপে অবতীর্ণ করেছি”। [সূরা ইউসুফ ১২:২]

 

একটি অনুবাদ শুধুমাত্র কুরআনের অর্থের একটি বিশ্লেষণমাত্র। অনুবাদে প্রকৃত কুরআনের অনুকরণীয় গুন পাওয়া যায় না। তাই সতর্ক, একটি অনুবাদ অর্থের প্রতিটি স্তরে মূল বার্তা প্রতিফলিত করতে পারে না। অনেক সময় উভয়ের মধ্যে প্রকৃত মিল ব্যাহত হয়। এ কারণেই যে সমস্ত ক্ষেত্রে কুরআন তিলাওয়াতকে আবশ্যিক করা হয়েছে, ওই সমস্ত ক্ষেত্রে আরবি ভাষাতেই কুরআন পাঠ অনিবার্য। যেমন, সালাতের মধ্যে কুরআন পাঠ।

 

দ্বিতীয় : কুরআনের কোনো নিখুঁত অনুবাদ নেই। আর মানুষের প্রায় প্রত্যেক কাজের মধ্যে কিছু একটা ত্রুটি থেকে যায়। কিছু অনুবাদ ভাষাগত মানের দিক থেকে উত্তম, আর কিছু অনুবাদে নির্ভুলতার উদ্দেশ্যে শুধু অর্থ উল্লেখ করা হয়। অনেক ভেজালযুক্ত, আর অনেক সময় বিভ্রান্তিকর অনুবাদ যেগুলো সাধারণভাবে কুরআনের নির্ভরযোগ্য অনুবাদ হিসেবে গ্রহণ করা হয় না, মূলধারার ব্যবসায়ী মুসলমানদের দ্বারা বাজারে বিক্রয় করা হচ্ছে।

 

তাফসির

যদিও কুরআনের অর্থ খুব সহজ ও বোধগম্য, তথাপি প্রত্যেকের উচিৎ কোনো বিশুদ্ধ তফসিরের উপর নির্ভর না করে ধর্মের ব্যাপারে কোনো উক্তি ব্যক্ত করার সময় আবশ্যিকভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা। রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু কুরআন নিয়ে আসেননি, বরং তিনি স্বীয় সাহাবিদেরকে তার ব্যাখ্যাও করে দেন। আর তাঁর ওই সমস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আজ পর্যন্ত হাদিসের আকারে সংকলিত ও সংরক্ষিত আছে। আল্লাহ্‌ তাআলা বলছেন : “এবংতোমারপ্রতিআমি স্মরণিকা অবতীর্ণ করেছি;যাতে তুমিলোকদের সামনে ঐসব বিষয় বিবৃত করোযেগুলো তাদেরপ্রতি নাযিল করা হয়েছে,যাতে তারা চিন্তাভাবনা করে”। [সূরা নাহ্‌ল ১৬:৪৪]

 

কুরআনের গভীর অর্থ অনুধাবন করার জন্য ওই সমস্ত তফসিরের উপর ভরসা করা উচিত যেগুলোতে রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও সাহাবাবর্গের উক্তি বিবৃত হয়েছে। মূল কুরআন সম্পর্কে তাঁদের শুধু বোধের উপর নির্ভর করা উচিত নয়, কেননা এই বিষয়ে তাঁদের বোধের পরিধি তাঁদের পূর্ববর্তীদের জ্ঞান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

 

কুরআনের সঠিক অর্থ নিষ্কাশনের জন্য তার ব্যাখ্যার একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি বিদ্যমান। কুরআনি বিজ্ঞান ইসলামি ছাত্রবৃত্তির একটি অত্যন্ত বিশেষায়িত ক্ষেত্র যার জন্য প্রয়োজন  একাধিক বিষয়ে বুৎপত্তি, যেমন : ব্যাখ্যা, তিলাওয়াত, লিপি, অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট, নাসিখ-মানসুখ, ব্যাকরণ, অসাধারণ পরিভাষা, ধর্মতাত্ত্বিক বিধানসমূহ এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্য।

 

কুরআনের ভাষ্যকারদের মতানুযায়ী কুরআনের বিশ্লেষণের প্রকৃত পদ্ধতিগুলি হলো :

(ক) কুরআন দ্বারা কুরআনের তফসির।

(খ) সুন্নাত দ্বারা কুরআনের তফসির।

(গ) সাহাবাবর্গের উক্তি দ্বারা কুরআনের তফসির।

(ঘ) আরবি ভাষাবিদ সাহাবিগণ এর যে অর্থ নিয়েছেন তাদ্বারা কুরআনের তফসির।

(ঙ) পণ্ডিতগণের মতামত দ্বারা কুরআনের তফসির যদি তা উপরোক্ত চারটি উৎসের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।

 

শিক্ষানবিশের জন্য সর্বশেষ পরামর্শবার্তা : পাঠকালীন যে সমস্ত প্রশ্ন মনের মধ্যে জাগবে সেগুলোকে লিখে রাখুন এবং যাঁরা ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান রাখেন তাঁদের নিকট সেগুলো নিয়ে যান আর যদি তাঁদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রমাণভিত্তিক হয় তাহলে তা গ্রহণ করুন।

 

কীভাবে আমাদের কুরআনের সাথে সম্পর্কিত থাকতে হবে ?

১। বিশুদ্ধ নিয়তে কুরআন পাঠ করুন

কুরআন দ্বারা সুপথপ্রাপ্তি ও পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য একনিষ্ঠভাবে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনার্থে তা পাঠ করা। প্রথমত, এই তিলাওয়াত যেন লোকের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য না হয়। দ্বিতীয়্ত, এই তিলাওয়াত যেন আন্তরিক হয় সত্যান্বেষণের জন্য হয়।

 

২। উপযুক্ত সময় ও স্থান নির্বাচন করুন, মনোযোগসহকারে পাঠ করুন এবং চিন্তাভাবনা করুন

কুরআন পাঠ করা উচিত উদার মস্তিষ্কে ও প্রকৃত নিয়মে। কুরআন পাঠ করার জন্য উপযুক্ত সময় নির্বাচন করুন, তাতে কুরআনে গবেষণা করা সহজতর হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্‌ তাআলা বলছেন : “এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্যেযার অনুধাবন করার মত অন্তর রয়েছে অথবা যেনিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে”। [সূরা ক্বাফ ৫০:৩৭]

প্রথম: বার্তা লাভের জন্য সর্বদা অন্তর খোলা রাখতে হবে। যদি অন্তর উম্মুক্ত না থাকে তাহলে ঠোঁট যতই নড়াচড়া করুক তাকে কিছু লাভ হবে না। দ্বিতীয় : কর্ণপাত মানে গভীর মনযোগ দিয়ে শ্রবণ করা এবং কী বলা হচ্ছে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করা। তৃতীয় : নিবিষ্ট মানে হৃদয় উপস্থিত থাকবে এবং যা বলা হচ্ছে তার সুরে বাঁধা থাকবে। যদি সবগুলি শর্ত পাওয়া যায় তাহলে একজন মানুষ কুরআন দ্বারা উপকৃত ও সুপথপ্রাপ্ত হতে পারে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, এতে চিন্তাভাবনা করা অভীষ্ট লক্ষ নয়, বরং অভীষ্ট লক্ষ হলো তার শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়িত করা।

 

৩। কুরআনকেই সত্যাসত্যের সিদ্ধান্ত নিতে দিন

যেন এমন হয় যে, কুরআন আপনাকে সুপথ প্রদর্শন করছে, আপনাকে সোজা পথ দেখাচ্ছে। উম্মুক্ত মনে এর সাথে আপনি সংযুক্ত থাকুন। যাদের মন প্রথম থেকেই কোনো বিষয়ের উপর স্থির থাকে তারা কুরআনের মধ্যে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন অনুসন্ধান করে। কুরআন তাদেরকে পথনির্দেশনা দেয় না, কারণ এর মধ্যে এই ফাঁক কখনোই ছিল না। যেকোনো নবমুসলিমের জন্য দরকার কুরআন অনুযায়ী নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে নেওয়া। পূর্বধারণার সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য এর ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। পূর্বের যে সমস্ত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আপনার অন্তঃকরণে বদ্ধমূল ছিল তা মুছে ফেলুন এবং নতুন গ্রন্থ হতে নতুন ও পরিষ্কার কিছু গ্রহণ করুন। কুরআনই আপনাকে সুপথ দেখাবে। তাছাড়া পূর্ববর্তী আকিদা-বিশ্বাসের মানদণ্ডে এটাকে পরিমাপ করার চেষ্টা করবেন না।

 

৪। কুরআনের সবকিছুই সত্য, এ কথা অনুধাবন করুন

আল্লাহর চাইতে অধিকসত্য কথা আর কার হবে”। [সূরা নিসা ৪:৮৭]

বিষয় যাই হোক, আল্লাহ্‌ তাআলা সত্য বলেন। বিষয়টি অদৃশ্য জগত, মৃত্যু পরবর্তী জীবন, ইতিহাস, প্রাকৃতিক আইন, সমাজবিজ্ঞান হোক বা অন্যকিছু, সবই আল্লাহ্‌ তাআলার পক্ষ হতে আসে। অনেক সময় মানুষ কিছু পড়ে আর ভাবে যে, এটা তো পারিপার্শ্বিক ঘটনার বিপরীত। এহেন অবস্থায় শিক্ষানবিশের এমন ভাবা উচিত যে, কুরআন যা বলছে হয়তো সে তা ভুল বুঝছে, অথবা সে বিষয়ে আরও ভালোভাবে বোঝার প্রয়োজন আছে, অথবা সে তা যথাযথ বুঝে উঠতে পারছে না। নতুন নতুন ঈমান আনয়ন করেছেন এমন কোনো ব্যক্তির জন্য বাঞ্ছনীয় নয় তাদের ধীশক্তির অভাবে কোনো আয়াতে সন্দেহপোষণ করা এবং তাদের পূর্বধর্ম ও তার সত্যতায় বিশ্বাস রাখা। কুরআনের সাথে চলুন, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অর্জন করুন নির্ভরযোগ্য ইসলামি বিদ্বাবগণের নিকট হতে এবং স্বীকৃত তফসিরগ্রন্থগুলি সাথে সম্পর্কিত থাকুন, যেমন তফসির ইবনে কাসির বা তফসিরে সা’দি।

 

৫। কুরআন আপনাকে সম্বোধন করে

বিশ্বাস করুন, কুরআন আপনাদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ্‌ তাআলা সরাসরি আপনাদের সঙ্গে কথা বলছেন। কুরআন শুধুমাত্র নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাবর্গের জন্য অবতীর্ণ হয়নি, বরং অবতীর্ণ হয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেকটি মানুষের জন্য। এই বাণী অবিনশ্বর প্রতিপালকের বাণী। এই বাণী চিরশ্বাশত বাণী। এটা সর্বকালের মানুষকে সম্বোধন করে। যখন আল্লাহ্‌ তাআলা কোনো নির্দেশ দেন তখন তা আপনার জন্যও হয়। এটা আপনারও পথনির্দেশিকা ও হৃদয়েয় সমস্ত ব্যাধীর নিরাময়। প্রতিটি আয়াতেই আপনার জন্য এক একটি করে বার্তা আছে। আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতিটি গুণবাচক নাম আপনাকে বলে একটি গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রতিটি বিবরণ আপনাকে বলে এর জন্য প্রস্তুতি নিতে। জান্নাতের প্রতিটি বিবরণ আপনাকে এর প্রতি উচ্চাভিলাষী ও উদ্‌গ্রীব করে। জাহান্নামের প্রতিটি বিবরণ আপনাকে  তা থেক আশ্রয় কামনার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। প্রতিটি বিষয় হয় অনুকরণীয় অথবা বর্জনীয়। প্রতিটি সংলাপেই আপনি শামিল আছেন। প্রতিটি আইনি আজ্ঞায় আপনার জন্য কিছু বার্তা আছে, যদিও আপনার অবস্থার জন্য প্রযুক্ত না হয়। এই অনুভূতিই আপনার হৃদয়কে সজাগ রাখবে। বিখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ বলেন : “যখন বলা হয় : “হে বিশ্বাসীগণ !” তখন তা গভীর মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করুন, হতে পারে ওতে এমন নির্দেশ আছে যা আপনার জন্য কল্যাণকর অথবা এমন নিষেধাজ্ঞা আছে যা আপনার জন্য ক্ষতিকারক”।

 

৬। সময় ও স্থানের সীমাবদ্ধতা থেকে কুরআনকে মুক্ত রাখুন

কুরআন একটি জীবন্ত পাঠ্য, আধুনিক জীবনের সাথে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক। নিঃসন্দেহে কুরআনের বহু আয়াতে ঐতিহাসিক ঘটনা আলোচিত হয়েছে। তাতে আলোচিত হয়েছে বিশিষ্ট কিছু লোকের বা বিশেষ কোনো ঘটনার। সঠিকভাবে কিছু আয়াত বোঝার জন্য ঐতিহাসিক প্রসঙ্গগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু উদাহরণ ও নৈতিক বিষয়গুলি আমাদের জীবনের সঙ্গে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক এবং আমাদের সময়কাল ও অবস্থার জন্য পথনির্দেশিকা। এ থেকে আমাদের মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত হয় যে, কুরআন প্রাচীন জাতি সম্পর্কে কথা বললেও তার নৈতিক পাঠ বর্তমান অবস্থার জন্য প্রযোজ্য।  

 

তথ্যসূত্র

http://www.newmuslims.com/category/157/

1538 Views
Correct us or Correct yourself
.
Comments
Top of page