ইসলামের নিরিখে ধৈর্য


ধৈর্যের আভিধানিক অর্থ বিলম্ব, সমস্যা, কষ্ট বা যন্ত্রণা ইত্যাদি মেনে নেওয়া বা সহ্য করা এবং তা করতে গিয়ে ক্রুদ্ধ বা অস্থিরচিত্ত না হওয়া। [১]

 

বিষয়সূচি

 

সংজ্ঞা

ধৈর্যের জন্য আরবি ভাষায় সবর শব্দটি ব্যবহৃত হয় যার আভিধানিক অর্থ আটকে রাখা, বিরত রাখা, বন্ধ রাখা। পারিভাষিক অর্থে ধৈর্য হলো : নৈরাশ্য, হতাশা ও নিদারুণ আতঙ্ক হতে নিজেকে আটকে রাখা, অভিযোগ হতে নিজেদের জিহ্বাকে সংযত রাখা এবং দুঃখ ও বিষাদের সময় মুখ ও বুক চাপড়ানো এবং বস্ত্র জীর্ণ করা থেকে নিজেদের হস্তকে সংযত রাখা। [২]

 

গুরুত্ব

ধৈর্য মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট গুণ। আমাদের চারিপাশে যাকিছু ঘটে থাকে সেগুলির প্রতি যদি আমরা গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে নিশ্চিতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হব যে, ধৈর্যই ও সবকিছুর সমাধান। ব্যবসায় গুরুতর পতন হোক বা কোনো অপ্রতিহত পরিস্থিতি, সবকিছু আমরা ধৈর্যের ঐশ্বরিক অস্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। বলা হয়, ধৈর্য একটি পুণ্য, কিন্তু আজকের সময়ে ধৈর্য পুরোপুরি একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছে। মানুষ ধৈর্যকে আলস্যের সাথে গুলিয়ে দেয়। কিন্তু ধৈর্যশীল হওয়া মানে অলস হওয়া নয়, বরং অভীষ্ট লক্ষে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কোমল ও স্থিরচিত্ত হওয়া যা সাফল্যের পথ দেখায়।  

 

কুরআনের আলোকে ধৈর্য

পবিত্র কুরআনে ধৈর্যের অশেষ গুরুত্ব বিবৃত হয়েছে এবং ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। যে কোনো  ধৈর্যশীল ব্যক্তি আল্লাহ্‌ তাআলার করুণা, অনুগ্রহ ও সুপথপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহ্‌ তাআলা ইরশাদ করছেন : “নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন”। [সূরা আল-ইমরান ৩: ১৪৬]

 

 “আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবনও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদেরকেসুসংবাদ দাও। যারাবিপদ-আপদে নিপতিত হলে বলে :নিশ্চয়ইআমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ইআমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী”। [সূরা বাকারা : ২:১৫৫-১৫৬]

 

“তোমরা ধৈর্য ধরো,নিশ্চয়ইআল্লাহ্‌ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন”। [সূরা আনফাল : ৪৬] “এবং তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মধ্যমে সাহায্য কামনা করো, আর অবশ্যই তা কঠিন; তবে বিনীতদের পক্ষে নয়, যারা ধারণা করে যে, নিশ্চয়ই তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে সম্মিলিত হবে এবং তারা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করবে”। [সূরা বাকারা ২:৪৫-৪৬] [৩]

 

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যের উত্তম দৃষ্টান্ত

নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানববিশ্বে ধৈর্যের সর্বোত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তিনি ধৈর্যের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেছেন। নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার অনতি দূরে তায়েফ শহরে গেলেন। তিনি সেখানে গেলেন তায়েফের জনসাধারণ ও নেতৃবৃন্দকে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য। তিনি তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানালেন। সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা শুধু ইসলামের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যানই করল না, বরং তারা এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাল। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ছোটো ছোটো শিশুদেরকে লেলিয়ে দিল তাঁকে বিদ্রুপ করার জন্য, তাঁর উপর পাথর বর্ষণ করার জন্য এবং তায়েফ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করে দেয়ার জন্য। নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতটাই রক্তাক্ত হয়েছিলেন যে, তাঁর জুতো রক্তে সিক্ত হয়ে পড়েছিল। জিব্রাইল (আ.) নবি (স.)-এর নিকট এসে বলছেন : “আপনি যদি চান তাহলে আমি দুইজন ফেরেশ্তাকে নির্দেশ দেব তারা দুই পর্বতের মধ্যস্থলে তায়েফের অধিবাসীদেরকে পিষে ধ্বংস করে দেবে”। নবি (স.) উত্তর দিলেন : “না, আমি আশা করি তাদের উত্তরসূরীগণ ইসলাম গ্রহণ করবে”। আল্লাহু আকবার !! এই ছিল আমাদের প্রিয়নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধৈর্য। (সহি মুসলিম : ৪৪২৫) [৪]

 

ধৈর্য ও অভিযোগ

অভিযোগ দুই প্রকার।

এক : আল্লাহ্‌র নিকট অভিযোগ। এটা ধৈর্যের সাংঘর্ষিক নয়। এমন অভিযোগ বিভিন্ন নবির মুখে শোনা গেছে। যেমন, ইয়াকুব (আ.) বলেছিলেন :

 “আমি আমার অসহনীয় বেদনা ও আমার দুঃখ শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র নিকট নিবেদন করছি”। [সূরা ইউসুফ ১২:৮৬]

 

তার পূর্বে ইয়াকুব (আ.) বলেছিলেন : “সবরুন জামিল” অর্থাৎ “ধৈর্যই আমার জন্য শ্রেয়”। আইয়ুব (আ.) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে :

“আর (স্মরণ করো)আইয়ুবের কথা, যখন তিনি তাঁর প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিলেন : আমি দুঃখ-কষ্টে নিমজ্জিত”। [সূরা আন্বিয়া ২১:৮৩]

 

নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় প্রতিপালকের নিকট দুআ করেছিলেন : “হে আল্লাহ্‌ ! আমি আমার দুর্বলতা ও অসহায়তার অভিযোগ কেবল তোমার নিকট করছি”। মুসা (আ.) দুআ করেছিলেন : “হে আল্লাহ্‌ ! সমস্ত প্রশংসা শুধু তোমারই, অভিযোগ করা হয় শুধু তোমারই নিকট, তুমি ওই সত্তা যাঁর নিকট আমরা সাহায্য কামনা করি, যাঁর উপর আমরা ভরসা করি এবং তোমার সাহায্য ছাড়া কারো কোনো ক্ষমতা নেই”।

 

দুই :দ্বিতীয় প্রকার অভিযোগ মানুষের কাছে করা হয়। কখনো তা করা হয় প্রত্যক্ষভাবে, অর্থাৎ ভাষার মাধ্যমে; আবার কখনো করা হয় পরোক্ষভাবে, অর্থাৎ অঙ্গভঙ্গি ও আচার-আচরণের মাধ্যমে। এটা সম্পূর্ণ ধৈর্যের বিপরীত।

 

ধৈর্য সম্পর্কে পণ্ডিতগণের উক্তি

কতিপয় পণ্ডিত ধৈর্যের সংজ্ঞায় বলেছেন : তা একটি ভালো মানুষের চারিত্রিক বা ইতিবাচক মানসিক মনোভাব, যার মাধ্যমে আমরা যা ভালো নয় তা হতে বিরত থাকতে পারি। মানুষ ধৈর্য ছাড়া একটি প্রকৃত ও সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে না।

 

আলি ইবনে আবু তালিব (রা.) বলেন : “ধৈর্য বলতে আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনাকে বোঝায়”।

 

আবু উসমান বলেন : “যার মধ্যে ধৈর্য আছে সে নিজেকে প্রশিক্ষিত করেছে কাঠিন্যকে জয় করার জন্য”।

 

আম্‌র ইবনে উসমান আল-মাক্কি বলেন : “ধৈর্য বলতে বোঝায় আল্লাহ্‌ তাআলার নৈকট্য লাভকে এবং তিনি যে বিপদ অবতীর্ণ করেন কারো নিকট তার অভিযোগ না করে কিংবা তাতে শোকাগ্রস্ত না হয়ে স্থিরচিত্তে সেটাকে মেনে নেয়াকে”।  

 

ইবনে কাইয়িম বলেন : “সুখীর সেরা জীবন ধৈর্যের মাধ্যমে সাধিত হয় এবং তারা তাদের কৃতজ্ঞতার মাধ্যমে সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে”।

 

আল-খাওওয়াস বলেন :  “কুরআন ও সুন্নাতের নিয়ম মেনে চলার নাম ধৈর্য”।

 

অন্য এক পণ্ডিত বলেন :  “অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকার নাম ধৈর্য”।[৫] [৬]

 

নীতি

ধৈর্য তিন প্রকার :

১) আনুগত্যের উপর ধৈর্য – আল্লাহ্‌ তাআলার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে যদি কাঠিন্য ও সমস্যার সম্মুখীন হয় তাহলে তাতে অবিচল থাকা। যেমন : আল্লাহ্‌ তাআলা চান আমরা যেন ফজরের সালাতের জন্য সকালে শীঘ্রই জেগে উঠি এবং এটাকে আমাদের দৈনন্দিন রুটিন বানিয়ে নিই, আর এর জন্য আমাদের প্রয়োজন হয় অতিশয় ধৈর্যশীল হওয়া। আমরা নিরাশ হব না বরং আল্লাহ্‌ তাআলার আদেশ পালন এবং তাঁর অনুগত হওয়ার জন্য আমাদেরকে কঠোর প্রয়াস চালাতে হবে।

 

২) বিপদে ধৈর্যধারণ – যেমন : যখন আমরা ব্যবসা, ধনসম্পদ ও সম্পত্তিতে গুরতর লোকসানের সম্মুখীন হই তখন আমাদেরকে ধৈর্যধারণ করতে হয় এবং কেবল তাঁর উপর ভরসা করতে হয়। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই ঘটে না। এই জীবন একটি পরীক্ষা এবং আল্লাহ্‌ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।

 

৩) পাপকার্য পরিহার করতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হলে ধৈর্যধারণ – যেমন : কেউ একজন চলচ্চিত্র দর্শন ও গান শ্রবণে অভ্যস্ত। এখন সে চাইছে সেগুলো বর্জন করতে, কিন্তু তা করতে গিয়ে তাকে বিভিন্ন সমস্যা ও কাঠিন্যের সম্মুখবর্তী হতে হচ্ছে; এহেন মুহূর্তে তাকে ধৈর্যধারণ করতে হবে, আল্লাহ্‌ তাআল তাকে সাহায্য করবেন এবং সে পুরস্কৃত হবে। [৭]  

 

আরও দেখুন :  আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান; নবি মুহাম্মাদ;  

 

তথ্যসূত্র

[১] http://www.thefreedictionary.com/patience

[২] http://www.islaam.net/main/display.php?id=1128&category=148

[৩] http://abdurrahman.org/character/patiencequransunnah.html

[৪] http://sunnah.com/muslim

[৫] http://abdurrahman.org/character/patiencequransunnah.html

[৬] http://www.islaam.net/main/display.php?id=1128&category=148

[৭] http://en.islamway.net/article/13189

2894 Views
Correct us or Correct yourself
.
Comments
Top of page