ইসলামের দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকেউ আমাদের উপকার করেছে, সেই উপকার সম্পর্কে যে আমরা সচেতন তা ওই ব্যক্তিকে অবহিত করার এবং তাতে আনন্দ প্রকাশ করার একটি উপায় হলো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। উপকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আমরা আমাদের ভাষায় “ধৈন্যবাদ” বলে থাকি। কৃতজ্ঞতা সময়, স্থান বা ধর্মের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় নিজ নিজ ভাষায় উপকারী লোককে ধৈন্যবাদ বলে। ইসলামে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আমরা প্রায় সবাই আমাদের জীবনে বিভিন্ন সমস্যা ও অসুবিধার সম্মুখীন হই। সুসময় ও দুঃসময় তথা সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ তাআলাকে স্মরণ করা ও আমাদের দুর্বলতা ও শক্তি সবসময় তাঁর কৃতজ্ঞ হওয়াই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করতে পারে : একজন দরিদ্র মানুষ তার দারিদ্রের জন্য কেন আল্লাহ্ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে ? !!
প্রকৃতপক্ষে, দারিদ্র কঠিনতম পরীক্ষাগুলির মধ্যে একটি যাদ্বারা আল্লাহ্ তাআলা একজন দরিদ্র মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। তিনি দেখেন, সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে কিনা। যদি সে কৃতজ্ঞ হয় তাহলে তার পুরস্কার মহানবি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর এই বাণীতে ঘোষিত হয়েছে : “বিত্তবানের পাঁচশত বছর পূর্বে বিত্তহীন জান্নাতে প্রবেশ করবে”। (তিরমিযি : ২৩৫১; রিয়াযুস স্বালিহীন : ৪৮৭)
কুরআনআমরা যদি আল্লাহ্ তাআলার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি তাহলে তিনি আমাদের প্রতি তাঁর কল্যাণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেন : “যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করোতবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর”। [সূরা ইব্রাহিম ১৪:৭]
আল্লাহ্ তাআলার আমাদের ধৈন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার প্রয়োজন নেই, পক্ষান্তরে তাঁর কৃতজ্ঞ হলে আমাদেরই কল্যাণ। আল্লাহ্ তাআলা বলেন : “আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে,আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়,সে তো কেবল স্বীয়কল্যানের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর সেঅকৃতজ্ঞ হলে তোআল্লাহ্অভাবমুক্তপ্রশংসিত”। [সূরা লুক্বমান ৩১:১২]
আল্লাহ্ তাআলা মু’মিনদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তার বিনিময়ে তাদেরকে তাঁর স্মরণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে : “সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ করো,আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো ওঅকৃতজ্ঞ হয়ো না”। [সূরা লুক্বমান ২:১৫২]
হাদিসআবু সাঈদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত আছে, মহানবি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন : “যে কেউ মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহ্রও কৃতজ্ঞ হয় না”। (তিরমিযি : ১৯৫৫; আবুদাউদ : ৪৮১১)
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের কৃতজ্ঞ হওয়া কত গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝানোর জন্য এর থেকে অধিক প্রাঞ্জল ও অর্থপূর্ণ বিবৃতি আর হতে পারে না।
আয়েশার বর্ণনায় পাওয়া যাচ্ছে যে, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রাত্রে দীর্ঘ সময় ধরে সালাত আদায় করতেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করছেন : “রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রাত্রে এতো দীর্ঘ সময় নিয়ে সালাত আদায় করতেন যে, তাঁর পাগুলো ফুলে যেত। আমি বললাম : “হে আল্লাহ্র রসূল ! আপনি এরকম কেন করছেন, অথচ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআলা আপনার পূর্বাপর সমস্ত পাপরাশি ক্ষমা করে দিয়েছেন ?” তিনি বললেন : “আমি কি আল্লাহ্র কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পছন্দ করব না ?”” (সহি বুখারি ৬/৩৬১) [১]
কারো কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন সম্পর্কে ইসলাম যা বলেআল্লাহ্ তাআলা আমাদের প্রতি যে নেয়ামত ও কল্যাণ দান করেছেন, তার জন্য শুধু তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের তারিফ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং তিনি আমাদেরকে আদেশ করেছেন ওই সমস্ত লোকের কৃতজ্ঞ হতে যারা আমাদের উপকার ও কল্যাণ করবে। একজন বান্দার নিকট যেমন “হাম্দ” (প্রশংসা) একটি কাম্য, অনুরূপ তার নিকট কাম্য “তাশাক্কুর” (কৃতজ্ঞতা)। ইসলাম ধর্মের নির্দেশ : মানুষ আল্লাহ্ তাআলার প্রশংসা (হাম্দ) করবে এবং মানুষের কৃতজ্ঞ হবে যারা আমাদের কল্যাণ করে।
কৃতজ্ঞতা অনুগ্রহ বৃদ্ধিতে সাহায্য করেআল্লাহ্ তাআলা বলেন : “যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে,যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো তাহলেতোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর”। [সূরা ইব্রাহিম ১৪:৭] অতএব, আমাদের জীবনে বৃহত্তর আকারে আল্লাহ্ তাআলার অনুগ্রহ ও কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য সকাল-সন্ধ্যার যিক্রসমূহে আল্লাহ্ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব।
উপকারের জবাবউসামা বিন যায়েদ (রা.) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন : “যে কেউ তার প্রতি কল্যাণকারী ব্যক্তিকে “জাযাকুমুল্লাহ্ খায়রান” (আল্লাহ্ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন) বলবে, সে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে”। (তিরমিযি : ২০৩৬)
তবে, কারো দ্বারা আমাদের কোনো উপকার সাধিত হলে আমরা ধৈন্যবাদ বলে আমাদের কৃতজ্ঞতার অনুভূতি প্রকাশ করি। সত্যি বলতে, কোনো উপকারের বিনিময় উপকার দেওয়া খুব জরুরি। তথাপি, প্রতিটি উপকারের বিনিময় একই ধরনের উপকার করা মানবজাতির জন্য প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে আমাদের মৌখিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন : “কোনো পুরস্কার দিতে তোমার হাত যদি সংকীর্ণ হয় তাহলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তোমার জিহ্বাকে যথেষ্ট লম্বা করো”।
রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিবরণ অনুযায়ী একটি উপকারের বিনিময়ে একইভাবে কোনো উপকার করা অপরিহার্য। আসলে আমরা যে শব্দটির অনুবাদ “উপকার” করছি তা হলো : “আতা”, যার মানে প্রদান করা। আমাদের ভাষায় আমরা এটাকে “আতিয়া”ও বলে থাকি। যদি একটি উপকারের বিনিময়ে অন্য একটি উপকার করা সম্ভব না হয় তাহলে কমপক্ষে তার তারিফ করা উচিত। অর্থাৎ আমাদের এমন কিছু বলতে হবে যা থেকে আমাদের আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকটিত হয় এবং উপকারী ব্যক্তিটি খুশি হয়। এর জন্য ওই ব্যক্তিকে ধৈন্যবাদ বলতে হবে অথবা তার জন্য দুআ করতে হবে। একটি হাদিসে উল্লেখ আছে : “যে প্রশংসা করল সে কৃতজ্ঞ হলো”।
কৃতজ্ঞতা আল্লাহ্ তাআলার শাস্তি দূরীকরণে সাহায্য করেআল্লাহ্ তাআলার অনুগ্রহ ও নেয়ামত সম্বন্ধে অজ্ঞতা আমাদের জন্য তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে অন্তরাল হয়ে দাঁড়ায়। আমরা জানি, আল্লাহ্ তাআলা যদি আমাদেরকে আমাদের অবহেলার জন্য শাস্তি দেন তাহলে সেই অধিকার তাঁর আছে। পবিত্র কুরআনে তিনি বলছেন : “যদি আল্লাহ্মানুষকে তাদের কৃতকর্মের কারণে পাকড়াও করতেন,তবে ভুপৃষ্ঠে চলমানকাউকে ছেড়ে দিতেন না। কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেন। অতঃপর যখন সে নির্দিষ্ট মেয়াদ এসে যাবে তখন আল্লাহর সব বান্দা তাঁর দৃষ্টিতে থাকবে”। [সূরা ফাতির৩৫:৪৫]
একই সময় আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় বলে দিয়েছেন, আর তা হলো তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। তিনি বলছেন : “তোমাদের আযাব দিয়ে আল্লাহ কীকরবেন যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করোএবং ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিতথাকো।আর আল্লাহ হচ্ছেন সমুচিত মূল্যদানকারী সর্বজ্ঞ”। [সূরা নিসা ৪:১৪৭] সুতরাং, আমাদের উপর আল্লাহ্ তাআলার প্রতিটি নেয়ামতের বিনিময়ে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য আমাদের হৃদয় পরিষ্কার করব।
উপসংহাররসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি (সা.) মুআয ইবনে জাবাল (রা.)-এর হাত ধরে বলেন : “এই মুআয ! আল্লাহ্র শপথ, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আল্লাহ্র শপথ, আমি তোমাকে ভালোবাসি”। অতঃপর তিনি বলেন : “মুআয ! তোমাকে আমার উপদেশ : প্রত্যেক সালাতের পরে এই দুআটি পড়তে ভুলো না : (আল্লাহুম্মা আ’ইন্নি ‘আলা যিক্রিকা ওয়া শুক্রিকা ওয়া হুস্নি '‘বাদাতিকা) {হে আল্লাহ্ ! তোমার স্মরণ, তোমার কৃতজ্ঞতা ও উত্তমরূপে তোমার ইবাদত প্রতিষ্ঠায় আমাকে সাহায্য করো}। (মুসনাদ আহ্মাদ : ৫/২৪৫; আবুদাউদ : ১৩০১ ও নাসায়ি : ১২৮৬) [২]
তথ্যসূত্র[১] http://www.onislam.net/english/reading-islam/understanding-islam/ethics-and-values/450257-expressing-gratitude-the-muslim-norm.html?Values= [২] http://www.iqrasense.com/muslim-character/the-blessings-of-gratitude-and-shukr.html |
.