আল্লাহ্র নাম ও গুণাবলিআল্লাহ্, ইশ্বরের প্রকৃত নাম, কিন্তু আমরা তাঁকে সাধারণত তাঁর গুণাবলির মাধ্যমে জানি। আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সামনে নিজেকে কীভাবে অভিব্যক্ত করেন, সেটাই প্রকাশ পায় তাঁর গুণাবলিতে। আল্লাহ্র গুণাবলি বেশুমার, তাই মানবমস্তিষ্ক সেই সর্বোচ্চ সত্তার প্রতিটি দিক কোনোক্রমেই পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না।
সুবিদিত যে, জ্ঞানেন্বষণের মর্যাদা নির্ভর করে, সেটা কোন শাখার জ্ঞান, তার উপর। আল্লাহ্ তাআল ও তাঁর গুণাবলি বিষয়ক জ্ঞানের তুলনায় অধিক মহত্ত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ জ্ঞানের আর কোনো শাখা নেই। জ্ঞানের এই শাখা মুসলিম-হৃদয়ে আল্লাহ্ তাআলার ভীতি ও ভালোবাসা সঞ্চারিত করে। জ্ঞানের এই শাখার উত্তুঙ্গ অবস্থার জন্য নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাবর্গের সম্মুখে এই মহত্ত্ব এই বলে উল্লেখ করতেন : “আল্লাহ্র শপথ, তাদের মধ্যে আল্লাত্ তাআলা সম্বন্ধে সর্বাধিক জ্ঞান আমিই রাখি এবং তাদের মধ্যে আমিই তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভয় করি”। (সহি মুসলিম : ৫৮১৪)
মানুষ মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্র ইবাদতের জন্য সৃষ্ট। এই উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তাআলার নাম ও গুণাবলির জ্ঞানের তাৎপর্য পরিষ্কার। কোনো ব্যক্তিই আল্লাহ্ তাআলা সম্বন্ধে না জেনে তাঁর ইবাদত করতে পারে না। আল্লাহ্ তাআলাকে আমরা যতবেশি জানব, আমাদের ইবাদত ততই উন্নত হবে। তাই আল্লাহ্ তাআলার নাম ও গুণাবলির প্রতি মনোসংযোগ করা এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য অত্যাবশ্যক, যে তাঁর ইবাদত ও জ্ঞানের বিভাগে অনুপ্রবেশ করতে ইচ্ছুক। আল্লাহ্ তাআলার নাম ও গুণাবলির সাথে পরিচিতি জ্ঞানের সেই মহাবিভাগ যা একজন মুসলমানকে তার প্রতিপালকের সান্নিধ্যে নিয়ে আসে।
কুরআন“আর আল্লাহ্র সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে; সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকবে। আর তাদেরকে বর্জন করো যারা তাঁর নাম বিকৃত করে; সত্বরই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল দেয়া হবে”। [সূরা আ’রাফ ৭:১৮০]
মহান আল্লাহ্ আরও বলেন : “তাঁরই উত্তম নাম রয়েছে”। [সূরা ত্ব-হা ২০:৮]
“বলো, আল্লাহ্র নামে ডাকো অথবা রহমান নামে ডাকো, তোমরা তাঁকে যে নামেই ডাকো তাঁর সব নামই তো সুন্দর”।[সূরা ইসরা ১৭:১১০]
হাদিসআবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন : “আল্লাহ্র ৯৯টি নাম রয়েছে, যে কেউ ওগুলো জানবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে”।(সহি বুখারি : ৩/৮৯৪ ও তিরমিযি : ৩৫০৬)
আল্লাহ্ তাআলার নামসমূহ ও গুণাবলির মধ্যে পার্থক্যআল্লাহ্ তাআলার নামসমূহ হলো ওই সমস্ত নাম যেগুলো স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলার সত্তাকে বোঝায়, তৎসহ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান নিখুঁত গুণাবলিকে বোঝায়। যেমন আল-ক্বাদীর (মহাশক্তিমান), আল-আলীম (সর্বজ্ঞ), আল-হাকীম (প্রজ্ঞাবান), আস-সামী’ (সর্বশ্রোতা), আল-বাসীর (সর্বদ্রষ্টা)। এই নামগুলি খোদ আল্লাহ্ তাআলার সত্তাকে বোঝায় এবং জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শ্রবণ, দর্শনের মতো তাঁর বিশেষত্বগুলিকে বোঝায়। অতএব নাম দুটি জিনিসকে বোঝায়, অপরপক্ষে বিশেষণ একটি জিনিসকে বোঝায়। আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল কর্তৃক বর্ণিত আল্লাহ তাআলার সমস্ত গুণাবলির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের জন্য অপরিহার্য। এছাড়া এও বিশ্বাস করতে হবে যে, তাঁর কোনো বিশেষত্য তাঁর সৃষ্টির কোনো বিশেষত্বের মতো নয়, ঠিক যেমন তাঁর সত্তা সৃষ্টির সত্তার ন্যায় নয়।
আল্লাহ্র ৯৯টি নাম
উলামাদের অভিমত
শায়খ মুহাম্মাদ স্বালিহুল উসাইমিন (রহঃ) বলেন: আল্লাহ্ তাআলার নাম ও গুণাবলি তাঁর সত্তার প্রেক্ষিতে নাম এবং শব্দগুলির মধ্যে নিহিত অর্থের প্রেক্ষিতে ওগুলি বিশেষণ। প্রথম প্রেক্ষিতে সেগুলো এক, কারণ সেগুলো বোঝায়কেবলমাত্র একক সত্তাকে যাঁকে আমরা আল্লাহ্ বলে জানি এবং দ্বিতীয় প্রেক্ষিতে সেগুলো ভিন্ন, কারণ প্রত্যেকটির মধ্যে একটি করে ভিন্ন অর্থ রয়েছে।
আল-হাইয়ু (জীবন্ত), আল-আলীম (সর্বজ্ঞ), আল-ক্বাদীর (সর্বশক্তিমান), আস-সামী’ (সর্বশ্রোতা), আল-বাসীর (সর্বদ্রষ্টা), আর-রহ্মান (পরম দয়ালু), আর-রহীম (অসীম কৃপাশীল), আল-আযীয (মহাক্ষমতাবান), আল-হাকীম (প্রজ্ঞাবান) প্রভৃতি নামগুলি এক সত্তা আল্লাহ্ তাআলার; কিন্তু আল-হাইয়ু (জীবন্ত)-র অর্থ আল-আলীম (সর্বজ্ঞ)-এর অর্থ হতে ভিন্ন এবং আল-আলীম (সর্বজ্ঞ)-এর অর্থ আল-ক্বাদীর (সর্বশক্তিমান)-এর অর্থ হতে ভিন্ন ইত্যাদি।
বরং আমরা বলি : সেগুলো একই সময় নাম এবং বিশেষণ দুটোই, কারণ কুরআন সেদিকেই ইঙ্গিত করেছে। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলছেন : “আর তিনি মহাক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু”। [সূরা ইউনুস ১০:১০]
“আর তোমার প্রতিপালক পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু”। [সূরা কাহ্ফ ১৮:৫৮]
দ্বিতীয় আয়াতটি হতে প্রকাশ হচ্ছে যে, পরম করুণাময় শুধু একজন, যাঁর মধ্যে করুণার বৈশিষ্ট্য আছে। ভাষাবিদদের ঐক্যমত এবং মানুষের ভাষাবোধ অনুযায়ী, কেবল এমন কাউকে আলীম বলা যায় যার মধ্যে জ্ঞান আছে; শুধুমাত্র এমন লোককেই সামী’ বলা যায় যার মধ্যে শোনার ক্ষমতা আছে; শুধু এমন ব্যক্তিকেই বাসীর বলা যায় যার মধ্যে দর্শনের গুণ আছে। আর এই বিষয়টি এতটাই স্পষ্ট যে, তার জন্য কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই। (আল-ক্বওয়াইদুল মাসলা ফি সিফাতিল্লাহ ওয়া আসমা-উহিল হুসনা : ৮)
ইবনে কাইয়িম (রহঃ) বলেন: আল্লাহ্ তাআলার নামসমূহ কোনো বিশেষ সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আল্লাহ্ আআলার কতিপয় নাম ও গুণাবলি অদৃশ্যের জ্ঞানের অন্তর্গত, যেগুলো কেবল তিনিই জানেন। সেগুলো ফেরেশ্তাগণও জানেন না যাঁরা তাঁর অতি নিকটস্থ অথবা নবিগণও জানেন না যাঁরা প্রেরিত, যেমন সহি হাদিসে উল্লেখ আছে : “আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি এমন প্রত্যেক নামের সাহায্যে, যে নামে তুমি নিজেকে নামাঙ্কিত করেছ, অথবা তোমার গ্রন্থে অভিব্যক্ত করেছ, কিংবা তোমার কোনো সৃষ্টিকে শিখিয়েছ, কিংবা অদৃশ্যের জ্ঞানের মধ্যে নিজের সঙ্গে সংরক্ষিত রেখেছ……”।
সুতরাং তাঁর নামসমূহকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায় : ১। ওই সমস্ত নাম যেগুলো দ্বারা তিনি নিজেকে নামাঙ্কিত করেছেন এবং ফেরেশ্তা বা অন্যদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি শিখিয়েছেন, কিন্তু তাঁর গ্রন্থের মধ্যে সেগুলো অবতীর্ণ করেননি। ২। ওই সমস্ত নাম যেগুলো তিনি স্বীয় গ্রন্থে অবতীর্ণ করেছেন এবং স্বীয় বান্দাদের শিখিয়েছেন। ৩। ওই সমস্ত নাম যেগুলো তিনি নিজের সঙ্গে রেখেছেন, অদৃশ্যের জ্ঞানের অন্তর্গত রেখেছেন, তাই কোনো সৃষ্টিই সেগুলো জানে না। তাইতো দুআয় উল্লেখ আছে : “তুমি সংরক্ষিত রেখেছে” অর্থাৎ কেবল তুমিই সেগুলো জানো। এর অর্থ এই যে, তিনি একমাত্র সত্তা যিনি ওই সমস্ত নামে নামাঙ্কিত, কারণ যে সমস্ত নাম কেবল তাঁর জন্য প্রমাণিত, সেগুলো ওই সমস্ত নামের অন্তর্ভুক্ত যেগুলো তিনি তাঁর গ্রন্থে অবতীর্ণ করেছেন। (বাদায়িদুল ফাওয়ায়িদ : ১/১৭৪-১৭৬)
ইবনে কাসির (রহঃ) বলছেন : উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ তাআলার সুন্দর নামগুলি ৯৯টির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়”। (তাফসির ইবনে কাসির : ২/৩২৮)
এছাড়া দেখুনমাজমুল ফাতাওয়া (ইবনে তাইমিয়া), ২২/৪৮২-৪৮৬
উপসংহারআল্লাহ্ তাআলার নামসমূহ, গুণাবলি ও কার্যসমূহ কোনো বিশেষ সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যে কেউ কুরআন ও সুন্নাতের প্রমাণগুলি অধ্যায়ন করে, আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা নিরীক্ষা করে এবং আল্লাহ্র নামসমূহ ও গুণাবলির প্রতি নিজের ঈমানের ভিত্তি সঠিক নিয়ম ও নির্দেশিকার উপর স্থাপন করে সে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহপোষণ করবে না।
গুণগুলি নামসমূহের সঙ্গে সুসংবদ্ধ। যে নামই আল্লাহ্র নাম হিসেবে সাব্যস্ত, তা এক একটি গুণকে বোঝায় যা তাঁর মর্যাদার সঙ্গে সুসামঞ্জস্যুপূর্ণ।
তথ্যসূত্রhttp://www.islamqa.com/en/ref/155478/attributes |
.